হার্ট ভালো রাখার সহজ উপায়: খাদ্য তালিকায় রাখুন এই ৫টি খাবার

সুস্থ থাকার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই হার্ট বা হৃদপিণ্ড ভালো রাখা অত্যন্ত জরুরি। আর হার্ট ভালো রাখতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, হার্টের জন্য কোন খাবারগুলো উপকারী। এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব কিভাবে খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আপনি আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে পারেন এবং কোন ৫টি খাবার আপনার খাদ্যতালিকায় অবশ্যই রাখা উচিত।

আমাদের হৃদপিণ্ড সারা শরীরে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান পৌঁছে দেয়। তাই হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখা অত্যন্ত জরুরি। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়, যার পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত।

এই আর্টিকেলে আপনি জানতে পারবেন হার্ট ভালো রাখার জন্য কোন খাবারগুলো আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত, কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এছাড়াও, হার্টের সমস্যা বোঝার উপায়, হার্টের কিছু জরুরি ঔষধের নাম এবং হার্টের রোগীদের জন্য একটি নমুনা খাবার তালিকা সম্পর্কেও ধারণা পাবেন।

আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে সহায়ক হবে।

আপনার হার্ট কি ভালো আছে? হার্টের সমস্যা বুঝবেন যেভাবে

heart disease1

আমাদের হৃদপিণ্ড শুধু রক্ত চলাচলের জন্যই দায়ী নয়, বরং সারা শরীরের সকল কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। সুষম খাদ্যতালিকা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন আপনার হার্টকে রাখবে সুস্থ ও সবল। আপনার ওজন যদি স্বাভাবিক থাকে, তাহলে সেটিও হার্ট ভালো থাকার একটি ইতিবাচক লক্ষণ।

একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হৃদস্পন্দনের হার বা বিট রেট থাকা উচিত প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০। তবে আমেরিকার মায়ো ক্লিনিকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাথলেটদের ক্ষেত্রে এই হার প্রতি মিনিটে ৪০-৪৫ এরও কম হতে পারে।

এই মাত্রার হার্ট রেট নির্দেশ করে যে আপনার হৃদপিণ্ড যথেষ্ট ভালো অবস্থায় আছে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেস’। হার্ট ভালো রাখার জন্য কোন খাবারগুলো উপকারী তা জেনে, সেগুলো খাদ্যতালিকায় রাখলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

তবে মনে রাখবেন, হার্ট যেহেতু শরীরের ভেতরের একটি অঙ্গ, তাই বিভিন্ন কারণে এতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই, আপনার হার্টে কোন সমস্যা হলে, কিছু লক্ষণের মাধ্যমে আপনি তা বুঝতে পারবেন।

যদি আপনার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি থাকে, তাহলে তা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি নির্দেশ করে। এছাড়াও, আরো কিছু বিষয় আছে যা আপনার হার্টের সমস্যার কারণ হতে পারে, যেমন: উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, বয়সজনিত জটিলতা, অতিরিক্ত ওজন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মাদকদ্রব্য সেবন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব। এইসব কারণে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।

MAYO CLINIC এর গাইডলাইন অনুযায়ী হার্টের সমস্যার লক্ষণ ও কারণসমূহ

তাই, আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি এড়াতে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানা অত্যন্ত জরুরি। কোন খাবারগুলো আপনার হার্টের জন্য উপকারী, সেটি জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হার্ট ভালো রাখার জন্য যে খাবারগুলো খাবেন: হার্ট সুস্থ রাখার জন্য ৫টি খাবার ও ঘরোয়া উপায়

হৃদরোগ থেকে দূরে থাকতে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত জরুরি। কিছু সহজলভ্য খাবার, যা আমরা ঘরোয়া উপায় হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, সেগুলো আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আসুন জেনে নিই হার্ট ভালো রাখার জন্য কোন ৫টি খাবার আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত।

heart disease3
  1. রসুন: রসুনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা হার্ট ব্লকের ঝুঁকি কমায়। এটি রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, রসুন উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও ভূমিকা রাখে। ঠান্ডাজনিত সমস্যা প্রতিরোধ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও রসুনের জুড়ি নেই। এসব গুণের কারণে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা রসুনকে “প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই হৃদপিণ্ড এবং সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন ২-৪ কোয়া কাঁচা রসুন খাওয়ার অভ্যাস করুন।
  2. আপেল: আপেল হৃদরোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকরী। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, থিয়ামিন, নিয়াসিন এবং কোলিন। একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, “প্রতিদিন একটি আপেল খান, ডাক্তারকে দূরে রাখুন”। তাই হার্টকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় একটি করে আপেল রাখুন।
  3. টক দই: চিনি ছাড়া টক দই শুধু হৃদপিণ্ডের জন্যই নয়, বরং পুরো শরীরের জন্যই অত্যন্ত উপকারী। যারা করোনারি হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন, তাদের জন্য টক দই আশীর্বাদস্বরূপ। টক দই পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এটি ত্বকের জন্যও বেশ উপকারী। তাই সপ্তাহে অন্তত ৪-৫ কাপ টক দই খাওয়ার চেষ্টা করুন।
  4. মিষ্টি আলু: অনেকের ধারণা, আলু খেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু মিষ্টি আলুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ভিন্ন। মিষ্টি আলু হলো লো-গ্লাইসেমিক ইনডেক্স জাতীয় খাবার। এতে রয়েছে দ্রবণীয় আঁশ, ভিটামিন এ এবং লাইকোপেন, যা হার্টের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় মিষ্টি আলু নিশ্চিন্তে রাখতে পারেন।
  5. ছোলা: ছোলা কার্ডিওভাসকুলার পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি খাবার। এর উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। ছোলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার এবং পটাশিয়াম। এটি রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। সকালে খালি পেটে কাঁচা ছোলা ভিজিয়ে খেলে তা হার্টের জন্য বিশেষভাবে উপকারী।

হার্টের জন্য উপকারী আরও কিছু খাবার:

এই ৫টি খাবার ছাড়াও আরও অনেক খাবার আছে যেগুলো হার্টের জন্য উপকারী। যেমন: পেয়ারা, কলা, কফি, লাউ, কমলালেবু, নাশপাতি, জাম্বুরা, গ্রিন টি, আদা, দুধ, আমলকি, লালমরিচ, কিডনি বিনস ইত্যাদি। নিয়মিত এই খাবারগুলো খেলে তা আপনার হার্টকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। বিশেষ করে যারা হৃদরোগী, তাদের খাদ্যতালিকায় এই খাবারগুলো রাখলে তা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে।

Harvard Health Publishing – অনুসারে হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার: কোনটি খাবেন, কোনটি বাদ দিবেন?

হার্টের ক্ষতি করতে পারে এমন ১০টি খাবারসমূহ

হার্ট ভালো রাখার জন্য কোন খাবারগুলো উপকারী, তা আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। তবে, শুধু উপকারী খাবার খেলেই চলবে না, হার্টকে সুস্থ রাখতে হলে আমাদের কিছু ক্ষতিকর খাবারও এড়িয়ে চলতে হবে। এই খাবারগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তাই, যতটা সম্ভব এই খাবারগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।

heart disease2

হার্টের জন্য ক্ষতিকর খাবারগুলোর তালিকা:

  1. কলিজা/মগজ: কলিজা এবং মগজে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল থাকে যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
  2. চিংড়ি: চিংড়ি মাছেও কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই হৃদরোগীদের চিংড়ি মাছ এড়িয়ে চলাই ভালো।
  3. ফাস্টফুড: ফাস্টফুড জাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে ট্রান্সফ্যাট থাকে যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
  4. মাছের ডিম/মাথা: মাছের ডিম এবং মাথা, বিশেষ করে বড় মাছের, কোলেস্টেরলে ভরপুর।
  5. রেড মিট: গরুর মাংস, খাসির মাংস ইত্যাদি রেড মিট স্যাচুরেটেড ফ্যাটে পরিপূর্ণ যা হার্টের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
  6. তৈলাক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার: অতিরিক্ত তেলযুক্ত এবং ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। এগুলোতে ট্রান্সফ্যাট থাকে যা হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
  7. নারিকেল: নারিকেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই নারিকেল খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
  8. অতিরিক্ত লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার: খাবারে অতিরিক্ত লবণ এবং চিনি দুটোই হার্টের জন্য ক্ষতিকর।
  9. কোমল পানীয়: কোমল পানীয়তে প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে যা স্থূলতা এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
  10. চানাচুর – বিস্কুট: প্রক্রিয়াজাত এই খাবারগুলোতে থাকে অস্বাস্থ্যকর তেল এবং উচ্চমাত্রার লবণ ও চিনি।

এই খাবারগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চললে আপনার হার্ট থাকবে সুস্থ এবং আপনি থাকবেন হৃদরোগের ঝুঁকি মুক্ত।

হার্টের ঔষধের নাম

heart disease4

আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি হার্ট ভালো রাখার জন্য কোন খাবারগুলো উপকারী। তবে, শুধু খাবারই যথেষ্ট নয়, কখনো কখনো হৃদরোগের জন্য ঔষধেরও প্রয়োজন হতে পারে। বাজারে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য অসংখ্য ঔষধ রয়েছে। তবে, এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মনে রাখা জরুরি, তা হলো, হৃদরোগের ঔষধ কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। একজন ডাক্তার রোগীর শারীরিক অবস্থা, রোগের লক্ষণ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় পর্যালোচনা করে ঔষধ দিয়ে থাকেন।

এখানে উদাহরণ হিসেবে দুটি ঔষধের নাম উল্লেখ করা হলো:

  • মিবেটা এস আর-৪০ ট্যাবলেট: এই ঔষধটি অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, উচ্চ রক্তচাপ, মাইগ্রেনের ব্যথা, বুকে ব্যথা, উদ্বেগ এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
  • নাইট্রোগ্লিসারিন: এই ঔষধটি হার্ট অ্যাটাকের ফলে সৃষ্ট বুকে ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

পুনরায় বলছি, এই ঔষধগুলো শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কখনোই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোন ঔষধ খাবেন না। হার্টের সমস্যা দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করুন।

আরও জানুন: অতিরিক্ত টেনশন দূর করার ১১টি সহজ উপায়

শেষ কথা: হার্ট সুস্থ রাখতে আপনার করণীয়

প্রিয় পাঠক, আশা করি এই আর্টিকেলটি পড়ার মাধ্যমে আপনি বুঝতে পেরেছেন যে হার্ট ভালো রাখার জন্য কোন খাবারগুলো উপকারী এবং কোন খাবারগুলো ক্ষতিকর। এছাড়াও, আর্টিকেলটিতে আলোচিত হার্ট সুস্থ রাখার উপায়গুলো আপনাকে একটি সুস্থ জীবনযাপনে সাহায্য করবে।

এই আর্টিকেলের মূল উদ্দেশ্য ছিল আপনাদের হার্টের যত্ন সম্পর্কে সচেতন করা এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধে উৎসাহিত করা।

আশা করি এই তথ্যগুলো আপনাদের উপকারে আসবে। যদি আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই শেয়ার করে আপনার বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদেরও হার্টের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে সচেতন করে তুলবেন। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।

Leave a Comment