ভ্রমণের নেশা মানুষকে ঘরছাড়া করে দূর-দূরান্তে নিয়ে যায়। কিন্তু যতই যা হোক, একটা সময় বিশ্রামের জন্য একটু আশ্রয় তো চাই-ই। আর সেই আশ্রয় দেওয়ার জন্যই তো রয়েছে আধুনিক যুগের হোটেল, ইন, মোটেল, এবং ব্যাকপ্যাক হোস্টেলগুলো। তবে হ্যাঁ, শুধু পয়সা খরচ করলেই হবে না। হোটেলে থাকারও কিছু নিয়ম-কানুন আছে। চাইলেই নিজের বাড়ির মতো যা খুশি তাই করা যায় না। কিছু ভদ্রতা এবং নিয়মকানুন মেনে চললে আপনার রুচির পরিচয় দেওয়া যায়। চলুন, জেনে নেওয়া যাক একজন ভ্রমণকারীর জন্য হোটেলে কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়।
সময় মেনে চলুন
হোটেলের সবকিছুই একটা নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলে। কখন চেক ইন করতে হবে, কখন রুম ছাড়তে হবে, কখন খাবার পাওয়া যাবে – সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকে। একজন অতিথি হিসেবে, এই নিয়মগুলো মেনে চলা আপনার দায়িত্ব। যদি আপনার চেক আউট করতে দেরি হয়, অথবা আপনি নির্ধারিত সময়ের আগে আপনার রুমে যেতে চান, তাহলে রিসেপশনে কথা বলে নিন। তারা আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। এছাড়াও, খাবার কখন পরিবেশন করা হবে, তারও একটি সময়সূচি থাকে। সেই অনুযায়ী আপনার দিনের পরিকল্পনা করুন। খাবারের সময়সূচি জেনে নিলে আপনার সুবিধা হবে।

বুফে ব্রেকফাস্ট, খাবার নষ্ট করার জায়গা নয়
অনেক হোটেলেই এখন বুফে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা থাকে। নানা ধরনের খাবার দেখে লোভ সামলানো কঠিন। কিন্তু দয়া করে নিজের প্রয়োজন ও রুচি অনুযায়ী খাবার নিন। প্লেটে বেশি খাবার তুলে নষ্ট করবেন না। আপনি যতটুকু খেতে পারবেন, ঠিক ততটুকুই খাবার নিন। খাবার নষ্ট করা মানে খাদ্যের অপচয় করা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সততা বজায় রাখুন
হোটেলের রুম বুক করার সময় সবসময় সৎ থাকুন। হয়তো আপনি দুইজনের জন্য ডাবল বেডের রুম বুক করেছেন, কিন্তু পরে আপনার সাথে আরও কয়েকজন যোগ দিলেন। এমন অবস্থায় কখনোই হোটেল কর্তৃপক্ষকে কিছু না জানিয়ে বেশি লোক নিয়ে রুমে উঠবেন না। এতে হোটেলের নিয়ম ভঙ্গ করা হয়। যদি আপনার ভ্রমণসঙ্গীর সংখ্যা বেড়ে যায়, তবে চেক-ইন করার আগেই রিসেপশনে জানান। তারা হয়তো আপনার জন্য অন্য কোনো রুমের ব্যবস্থা করতে পারবে অথবা অতিরিক্ত লোকের জন্য কিছু চার্জ নিতে পারে। কিন্তু তাদেরকে না জানিয়ে বেশি লোক নিয়ে উঠলে, তারা আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
হট্টগোল পরিহার করুন
হোটেলে থাকার সময় মনে রাখবেন, আপনার আশেপাশের রুমগুলোতেও অন্য মানুষজন থাকতে পারে। তারা হয়তো কেউ কাজ করছে, কেউ বিশ্রাম নিচ্ছে, অথবা কেউ হয়তো অসুস্থ। প্রত্যেকেরই নিজস্ব গোপনীয়তা এবং বিশ্রামের অধিকার আছে। তাই দয়া করে আপনার আনন্দ-উল্লাস একটু সংযত রাখুন। হোটেলের রুমে বা করিডোরে বেশি হট্টগোল করা থেকে বিরত থাকুন। আপনার আনন্দ হয়তো অন্যদের বিরক্তির কারণ হতে পারে।
হোটেলে থাকার সময় এড়িয়ে চলা উচিত এমন ৯টি আচরণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে, Business Insider-এর বিস্তৃত প্রতিবেদনটি পড়ুন।
শিশুদের প্রতি খেয়াল রাখুন
যদি হোটেলে বেবি কেয়ার সার্ভিস বা ন্যানি সেবা না থাকে, তাহলে আপনার বাচ্চাদের সামলানোর দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। শিশুরা স্বভাবতই চঞ্চল হয় এবং তারা হৈচৈ করতে ভালোবাসে। তবে তাদের চঞ্চলতার কারণে হোটেলের জিনিসপত্র নষ্ট না হয় বা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। এছাড়াও, আপনার শিশুর জন্য যেন হোটেলের অন্য অতিথিদের কোনো সমস্যা না হয়, সেটিও নিশ্চিত করা ভদ্রতার পরিচয়।

রুম সার্ভিস সম্পর্কে জেনে নিন
বাড়ি আর হোটেলের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, দৈনন্দিন কাজ করার জন্য এখানে আলাদা লোক ও সার্ভিস রয়েছে। তবে এর মানে এই নয় যে আপনি মধ্যরাত বা ভোরবেলায় রুম/লন্ড্রি সার্ভিসের আশা করবেন। রিসেপশনে কথা বলে রুম সার্ভিসের সময় জেনে নিন। নির্ধারিত রুম সার্ভিসের বাইরে বিশেষ কোনো সেবা, সময়ে-অসময়ে দাবি না করাই ভালো। হোটেলের নিয়ম মেনে চলুন। নিজের পছন্দমতো সেবা নিতে হোটেল কর্মীদের ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এতে আপনার নিজের সম্মান এবং হোটেল কর্মীর চাকরি দুটোই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আরও পড়ুন- কম খরচে বিদেশ ভ্রমণ: ১৫টি অত্যন্ত কার্যকর ও সাশ্রয়ী টিপস
পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
বেশিরভাগ হোটেলেই হাউজকিপিং-এর ব্যবস্থা থাকে। তার মানে এই নয় যে আপনি যেমন খুশি তেমন করে রুম নোংরা করবেন আর তারা এসে পরিষ্কার করে দেবে। হোটেলের জিনিসপত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন এবং নিজের রুম যতটা সম্ভব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। যত্রতত্র ময়লা না ফেলে ট্র্যাশ ক্যান ব্যবহার করুন। ভেজা তোয়ালে বা গ্লাস আসবাবপত্রের উপর না রেখে ট্রে বা র্যাকে রাখুন। এই ছোট ছোট কাজগুলো আপনার রুচির পরিচয় দেবে।
পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গড়ে তুলুন
আপনি টাকা দিয়ে থাকছেন বলে হোটেলের বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং অন্যান্য সুবিধা ইচ্ছে মতো ব্যবহার করবেন না। নিজের পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবুন। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে লাইট, ফ্যান, এসি, টিভি, হেয়ার ড্রায়ার ইত্যাদি বন্ধ করে দিন। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে আর পরিবেশও কম দূষিত হবে।

ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না
আমাদের দেশে ছোটবেলা থেকেই ‘ধন্যবাদ’ বলা তেমন প্রচলিত হয়নি, কিন্তু এই সহজ শব্দটি অন্য কারো মুখে হাসি ফোটাতে পারে। একজন ভ্রমণকারী হিসেবে, চেক-আউটের সময় হোটেলের স্টাফদের ধন্যবাদ জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা আপনার ভ্রমণকে আরামদায়ক করার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করে।
হোটেলের ফিডব্যাক নোটে সংক্ষেপে আপনার ভালো লাগা ও কম ভালো লাগা বিষয়গুলো উল্লেখ করলে ভবিষ্যতে সেবার মান উন্নত করতে অনেক সহায়তা হয়। প্রয়োজনে চেক-আউটের সময় কিছু টিপসও দিয়ে যেতে পারেন। আর যদি আপনি হোটেলের সেবা পেয়ে সন্তুষ্ট হন, তাহলে সামাজিক মাধ্যম বা গল্পে এর কথা শেয়ার করে অন্যান্য ভ্রমণকারীদেরও উৎসাহিত করুন। এই ছোট্ট কাজ আপনার কমিউনিটিকে এগিয়ে নিতে এবং সকলের জন্য একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
আরও বিস্তারিত জানতে যায়যায়দিন এর এই প্রতিবেদনটি পড়ুন: আবাসিক হোটেলে যে কাজগুলো করবেন না
শেষ কথা
জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে রুচি ও শিক্ষার অসামান্য পরিচয় আমাদের ছোট ছোট আচরণ থেকেই প্রকাশ পায়। একজন ভ্রমণকারী হিসেবে, আমাদের এই আদবকেতা শুধু নিজেকে সমৃদ্ধ করে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দায়িত্ববোধও তুলে ধরে। এই সজাগ ও ইতিবাচক আচরণগুলোই আমাদের ভ্রমণকে আরও স্মরণীয় করে তোলে এবং একে একে সমাজে প্রগতিশীল পরিবর্তনের সূচনা করে।